‘সোনাদিয়া দ্বীপ’ যেন মালয়েশিয়া

আরফাতুল মজিদ, কক্সবাজার •

গত ২২ মার্চ রাতে মহেশখালীর সোনাদিয়া দ্বীপ থেকে আছিয়া নামে এক রোহিঙ্গা নারীকে উদ্ধার করেছে পুলিশ। ১৫ বছর বয়সী আছিয়া বলেন, ক্যাম্পে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে কষ্ট হচ্ছে। মা-বাবা বলেছে, যেদিকে চোখ যায় সেদিকে চলে যেতে। আল্লাহর উপর ভরসা করে মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য ট্রলারে রওনা হয়েছিলাম। পরে সোনাদিয়া থেকে পুলিশ উদ্ধার করেছে। ওই দিন আছিয়ার মতো আরও ১৪৯ জন রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করেছিল পুলিশ।

কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘সাগরপথে মালয়েশিয়া নিয়ে যাওয়ার কথা বলে সোনাদিয়া দ্বীপে ট্রলার থেকে নামিয়ে দেওয়া হয় ১৪৯ রোহিঙ্গাকে। দ্বীপে বিক্ষিপ্ত অবস্থায় ঘোরাঘুরি করার সময় তাদের উদ্ধার করা হয়। তাদের মধ্যে ৭৫ জন নারী, ৫১ জন পুরুষ ও ২৩ জন শিশু। সবাই উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্পের বাসিন্দা।

খতিজা নামের আরেক রোহিঙ্গা নারী বলেন, ‘দেশে যেতে পারছি না। ক্যাম্পেও থাকতে ইচ্ছে করছে না। মালয়েশিয়ায় আত্মীয়-স্বজন আছে। তাই মালয়েশিয়া চলে যাচ্ছিলাম।’

মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পভিত্তিক দালালচক্রের মাধ্যমে সাগরপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য ট্রলারে তুলেছিল। ১০-১২ দিন সাগরে ট্রলার ভাসিয়ে মালয়েশিয়া পৌঁছানোর কথা বলে তাদের মহেশখালীর সোনাদিয়া উপকূলে নামিয়ে দেওয়া হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কক্সবাজারে ভয়ংকর হয়ে উঠেছে মানব পাচার চক্র। বেশি বেতনে ভালো চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে রোহিঙ্গাদের পাচার করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে পাচারকারী চক্র। এছাড়াও বিয়ের প্রলোভনে মালয়েশিয়া পাড়ি দেওয়ার কথা বলেও রোহিঙ্গা নারীদের টার্গেট করা হয়।

গোয়েন্দা সংস্থা সূত্র জানায়, কক্সবাজারে বর্তমানে ১৩ থেকে ১৫টি দালাল চক্র সক্রিয় রয়েছে। প্রত্যেক চক্রে ১৫-২৫ জন সদস্য রয়েছে। এই চক্রের সদস্যরা মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর পৌঁছানোর কথা বলে জনপ্রতি ২০ হাজার করে টাকা করে নেয়। এরপর নেয় ৩০-৫০ হাজার টাকা। ট্রলারে কিছু শুকনো খাবার তুলে দিয়ে পাড়ি দেয় সাগর পথে।

গোয়েন্দা সংস্থার তালিকা অনুযায়ী, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মানবপাচারে জড়িত ১৬ নম্বর ক্যাম্পের মো. সায়ীদের ছেলে রোহিঙ্গা মো. রফিক ও বাদশা মিয়ার ছেলে হারুনের নেতৃত্বে অন্তত ৫০ জন আছে। এছাড়া দালালচক্রের নেতৃত্বে আছে শাহপরীর দ্বীপের ধলু হোসেন ও শরীফ হোসেন। তাদের বিরুদ্ধে টেকনাফ থানায় অন্তত ১২টি মামলা রয়েছে।

নতুন ঘাঁটি কুতুবজোম :

মহেশখালীতে পাচারকারী চক্রের প্রধান ‘ঘাঁটি’ হচ্ছে কুতুবজোম ইউনিয়ন। মানব পাচারের তালিকায় থাকা বড় চক্র রয়েছে কুতুবজোনে। এর নেতৃত্বে রয়েছে তাজিয়াকাটা এলাকার নূর ওরফে বার্মাইয়া নূর। নূরের ভাই সেলিম, তাদের ভাগনে সোহেল, কুতুবজোম পশ্চিম পাড়ার আবদুর রহিম ও তার ফুফাতো ভাই লুতু মিয়া। নূর চক্রের প্রধান হোতা টেকনাফের সাবরাংয়ের কাটাবনিয়ার শহিদ উল্লাহ। মানব পাচার মামলায় প্রধান আসামি করা হয়েছে।

কুতুবজোন ইউপি চেয়ারম্যান শেখ কামাল বলেন, কুতুবজোনকেন্দ্রিক মানব পাচারকারী চক্র সক্রিয় হয়ে উঠেছে। চিহ্নিত ইয়াবা পাচারকারী চক্রগুলোই মানব পাচারে সক্রিয়। বেশি টাকা আয়ের লোভেই ইয়াবা ব্যবসীয়ারা মানব পাচারে সক্রিয় হয়ে ওঠে।

ক্যাম্পে সক্রিয় :

উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা শিবিরে মানবপাচারকারী চক্র সক্রিয় হয়ে উঠেছে দীর্ঘদিন ধরে। এতে সক্রিয় রয়েছে হাফেজ ছলিম, আতাত উদ্দিন, মোহাম্মদ আলম, আবদুর করিম, হাফেজ মোহাম্মদ আইয়ুব, আবদুল করিম, মোহাম্মদ ইলিয়াছ, মোহাম্মদ কবির, আমির হোসেন, মোহাম্মদ ফয়েজ, নূর হোছন, মোহাম্মদ নাগু, নুরুল কবির, আবুল কালাম, লাল বেলাল, দিল মোহাম্মদ, মোহাম্মদ ফারুক, জোবাইর হোসেন, লালু মাঝি, আলী আকবর, ইমাম হোসেন ও শুক্কুর। মোহাম্মদ ছলিম, লম্বা কবির, মোহাম্মদ শাহর বিরুদ্ধে মামলা থাকলেও এলাকায় তারা পাচারে তৎপর রয়েছে বলে অভিযোগ আছে।

উপকূলের পয়েন্ট :

টেকনাফের সাগর তীরবর্তী কক্সবাজারের নুনিয়াছটা, ফিশারিঘাট, নাজিরাটেক, সমিতিপাড়া; মহেশখালীর সোনাদিয়া, গোরকঘাটা, কুতুবজোম, ধলঘাটা; উখিয়ার সোনারপাড়া, রেজুরখাল, ইনানী, ছেপটখালী, মনখালী; টেকনাফের বাহারছড়া, নোয়াখালী, শাহপরীরদ্বীপ, কাটাবনিয়া, খুরেরমুখ, হাদুরছড়া, জাহাজপুরা, কচ্ছপিয়া, শামলাপুর সদরের ঈদগাঁও, খুরুশকুল, চৌফল-ী, পিএমখালী, চকরিয়া, পেকুয়া; চট্টগ্রামের বাঁশখালী, আনোয়ারা উল্লেখযোগ্য।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দাবি, কক্সবাজারের সমুদ্র উপকূল দিয়ে সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় লোক পাঠানোর কাজে জড়িত অন্তত ৫শ দালালকে চিহ্নিত করা হয়েছে।

কক্সবাজার পিপলস ফোরামের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ ইকবাল বলেন, ‘বিগত কয়েক বছর ধরেই আমরা দেখছি, গডফাদারদের সহযোগীদের আটক করা হলেও তাদের গডফাদারদের কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। প্রভাবশালীদের আইনের আওতায় আনতে হবে। তবেই পাচার স্থায়ীভাবে বন্ধ হবে।’

কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. মাহফুজুল ইসলাম বলেন, ‘সাগরপথে মানব পাচারের ঘটনা বাড়ায় নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। রোহিঙ্গা অপরাধীরাও এ কাজে জড়িত। তাদের চিহ্নিত করতে আমরা কাজ করছি।’